১.যাকাতের অর্থে ফকির প্রকল্প

ফকির এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে নিজের জীবিকার ব্যাপারে অন্যের মুখাপেক্ষী। কোন শারীরিক  ত্রুটি বা বাধ্যর্ক্যজনিত কারণে কেউ স্থায়ীভাবে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে অথবা কোন সাময়িক কারণে আপাতত কোন ব্যক্তি অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে এবং সাহায্য সহায়তা পেলে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, এ পর্যায়ের সব ধরনের অভাবী লোকের জন্য সাধারণভাবে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন এতীম শিশু, বিধবা নারী, উপার্জনহীন বেকার এবং এমন সব লোক যারা সাময়িক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ফকিরদের জন্য যে সকল কর্মসূচী ফাউন্ডেশন চালু করা হয়েছে :
জরুরী  খাদ্য, বস্ত্র, তাবু সরবরাহ (বিশেষ ভাবে সেহরী, ইফতারী, ঈদ সামগ্রী, কুরবানী গোস্ত বিতরণ)
কর্মক্ষম বেকার, গরিব যুবকদের কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে পঁুজি, রিকশা, ভ্যান, সেলাই মেশিন, কৃষি ও শিল্প কাজের সরঞ্জামাদি ও কাঁচামাল সরবরাহ করা।
গরীব—মেধাবী ছাত্র—ছাত্রীদের শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা।

০২. মিসকিন প্রকল্প

মাসাকিন  হল মিসকিন এর বহু বচন। মিসকীন শব্দের মধ্যে দ্বীনতা, দুর্ভাগ্য পীড়িত অভাব, অসহায়তা লাঞ্ছনা অর্থ নিহিত রয়েছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে সাধারণ অভাবীদের চাইতে যাদের অবস্থা বেশী খারাপ তারাই মিসকীন। নবী (সা.) শব্দটির ব্যাখ্যা করে বিশেষ করে এমন সব লোকদেরকে সাহায্য লাভের অধিকারী গণ্য করেছেন, যারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উপায়উপকরণ লাভ করতে পারেনি, ফলে অত্যন্ত অভাব দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু তাদের পদমর্যাদা সচেতনতা কারোর সামনে তাদের হাত পাতার অনুমতি দেয় না। আবার তাদের বাহ্যিক অবস্থাও এমন নয় যে, কেউ তাদেরকে দেখে অভাবী মনে করবে এবং সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিবে। হাদীসে এভাবে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে

"যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থসম্পদ পায় না, যাকে সাহায্য করার জন্য চিহ্নিত করা যায় না এবং যে নিজে দাঁড়িয়ে কারোর কাছে সাহায্যও চায় না, সে মিসকীনঅর্থাৎ সে একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্র গরীব মানুষ।

             খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসাসেবায় সহায়তা

             কর্জে হাসানা প্রদান করা।

০৩. আমেলীন (যাকাত অফিসার) প্রকল্প

আমেলীন অর্থাৎ যারা সাদকা আদায় করা, আদায় করা ধনসম্পদ সংরক্ষণ করা, সে সবের হিসেবনিকেশ করা, খাতাপত্রে লেখা এবং লোকদের মধ্যে বণ্টন করার কাজে সরকার বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিযুক্ত থাকে। ফকীর বা মিসকীন না হলেও এসব লোকের বেতন সর্বাবস্থায় সাদকার খাত থেকে দেয়া হবে। এখানে উচ্চারিত শব্দগুলো এবং সুরার ১০৩ আয়াতের শব্দাবলী خُذْمِنْأَمْوَالِهِمْصَدَقَةً (তাদের ধনসম্পদ থেকে সদাকা উসূল করো) একথাই প্রমাণ করে যে, যাকাত আদায় বণ্টন ইসলামী রাষ্টে্রর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুপুস্থিতিতে বেসরকারী ইসলামী সংস্থা বা বেসরকারী যাকাত প্রতিষ্ঠান আদায় বন্টন ব্যবস্থায় নিয়োজিত কর্মচারী, কর্মকর্তা   নির্বাহীগন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের নির্ধারিত বেতন ভাতা সুযোগ সুবিধা পাবেন।

এই খাতে আমরা ওয়াল্ড যাকাত ফোরাম বিভিন্ন ইসলামী সংস্থার ফতোয়া অনুযায়ী নিম্নরূপ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে:

             কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা, অফিস ভাড়া,ইউটিলিটি বিল প্রদান করা।

             কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষন ব্যয় বহন করা।

             প্রশিক্ষনের মাধ্যমে গরীব শিক্ষিত বেকারদের কর্মোদ্যক্তা বানাতে পুঁজি সরবরাহ করা।

০৪. মুয়াল্লাফাতুল কুলুব বা মনঃতুষ্টি প্রকল্প

মন জয় করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করার যে হুকুম এখানে দেয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা ইসলামের বিরোধীতায় ব্যাপকভাবে তৎপর এবং অর্থ দিয়ে যাদের শত্রুতার তীব্রতা উগ্রতা হ্রাস করা যেতে পারে অথবা যারা কাফেরদের শিবিরে অবস্থান করেছে ঠিকই কিন্তু অর্থের সাহায্যে সেখান থেকে ভাগিয়ে এনে মুসলমানদের দলে ভিড়িয়ে দিলে তারা মুসলমানদের সাহায্যকারী হতে পারে কিংবা যারা সবেমাত্র ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং তাদের পূর্বেকার শত্রুতা বা দুর্বলতাগুলো দেখে আশঙ্কা জাগে যে, অর্থ দিয়ে তাদের বশীভূত না করলে তারা আবার কুফরীর দিকে ফিরে যাবে, ধরনের লোকেদেরকে স্থায়ীভাবে বৃত্তি দিয়ে বা সাময়িকভাবে এককালীন দানের মাধ্যমে ইসলামের সমর্থক সাহায্যকারী অথবা বাধ্য অনুগত কিংবা কমপক্ষে এমন শত্রুতে পরিণত করা যায়, যারা কোন প্রকার ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। খাতে গণিমতের মাল অন্যান্য উপায়ে অর্জিত অর্থ থেকেও ব্যয় করা যেতে পারে এবং প্রয়োজন হলে যাকাতের তহবিল থেকেও ব্যয় করা যায়। ধরনের লোকদের জন্য, ফকির, মিসকিন বা মুসাফির হবার শর্ত নেই। বরং ধনী বিত্তশালী হওয়া সত্ত্বেও তাদের যাকাত দেয়া যেতে পারে।ফতোয়া অনুযায়ী নিম্নরূপ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে :

             অসহায় নওমুসলিমদের কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে পঁুজি সরবরাহ করা।

             জরুরী খাদ্য, বস্ত্র, সরবরাহ করা।

             নওমুসলিমদেও ইসলামের সৌন্দর্য বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

৫. রিকাক বা দাস মুক্ত করণ প্রকল্প

দাসদেরকে দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা দুভাবে হতে পারে। এক, যে দাস তার মালিকের সাথে মর্মে চুক্তি করেছে যে, সে একটা বিশেষ পরিমাণ অর্থ আদায় করলে মালিক তাকে দাসত্ব মুক্ত করে দেবে। তাকে দাসত্ব মুক্তির মূল্য আদায় করতে যাকাত থেকে সাহায্য করা যায়। দুই, যাকাতের অর্থে দাস কিনে তাকে মুক্ত করে দেয়া। আধুনিক কালে জেল থেকে মুক্তির জন্য যাকাতের টাকা দেয়া যেতে পারে।

আমাদের দেশে যেহেতু দাস প্রথা নেই। সেক্ষেত্রে চাহিদার আলোকে ফতোয়া অনুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণ হবে।

০৬. ঋণগ্রস্থদেও সাহায্য প্রকল্প

এমন ধরনের ঋণগ্রস্থ, যারা নিজেদেও সমস্ত ঋণ আদায় কেও দিলে তাদেও কাছে নেসাবের চাইতে কম পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে। তারা অর্থ উপার্জনকারী হোক বা বেকার, আবার সাধারণ্যে তাদেও ফকীর মনে করা হোক বা ধনী। উভয় অবস্থায় যাকাতের খাত থেকে তাদেরকে সাহায্য করা যেতে পারে। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক ফকীহ মত পোষণ করেছেন যে, অসৎকাজে অমিতব্যয়িতা কেও যারা নিজেদেও টাকা পয়সা উড়িয়ে দিয়ে ঋণের ভােও ডুবে মরছে, তাওবা না করা পর্যন্ত তাদেও সাহায্য করা যাবে না। ফতোয়া অনুযায়ী নিম্নরূপ কর্মসূচী গস্খহণ করা হয়েছে :

              কর্জে হাসানা প্রদান করা।

ছাড়া যাকাত অফিসারদের মাধ্যমে, প্রস্তাবিত ঋণগ্রস্থদেও আবেদন শরীয়াহ বিশেজ্ঞ কমিটি বোর্ড অব ডাইরেক্টরসএর অনুমোদন সাপেক্ষে ঋণ পরিশোধ করার জন্য সহায়তা করা।

০৭. আল্লাহর পথে

আল্লাহর পথে শব্দ দুটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেসব সৎকাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট এমন সমস্ত কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। কারণে কেউ কেউ এমত পোষণ করেছেন যে, হুকুমের প্রেক্ষিতে যাকাতের অর্থ যে কোন সৎকাজে ব্যয় করা যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রথম যুগের ইমামগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে মত পোষণ করেছে সেটিই যথার্থ সত্য। তাদেও মতে এখানে আল্লাহর পথে বলতে আল্লাহর পথে জিহাদ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যেসব প্রচেষ্টা সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য কুফরী ব্যবস্থাকে উৎখাত কেও ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। যেসব লোক প্রচেষ্টা সংগ্রাম রত থাকে, তারা নিজেরা ¦চ্ছল অবস্থা সম্পন্ন হলেও এবং নিজেদেও ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাদেরকে সাহায্য করার প্রয়োজন না থাকলেও তাদেও সফর খরচ বাবদ এবং বাহন, অস্ত্রশস্ত্র সাজসরঞ্জাম ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। অনুরূপ ভাবে যারা স্বেচ্ছায় নিজেদেও সমস্ত সময় শ্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে উদ্দেশ্য নিয়োজিত কেও তাদেও প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যও যাকাতের অর্থ এককালীন বা নিয়মিত ব্যয় করা যেতে পারে।

এখানে আর এশটি কথা অনুধাবন করতে হবে। প্রথম যুগের ইমামগণের বক্তব্য সাধারণত এক্ষেত্রে গাযওয়া শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দটি যুদ্ধেও সমর্থক। তাই লোকেরা মনে কেও যাকাতের ব্যয় খাতে ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর পথের যে খাত রাখা হয়েছে তা শুধু যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু আসলে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ যুদ্ধ বিগ্রহের চাইতে আরো ব্যাপকতর জিনিসের নাম। কুফরের বাণীকে অবদমিত এবং আল্লাহর বাণীকে শক্তিশালী বিজয়ী করা আর আল্লাহর দ্বীনকে এশটি জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কায়েম করার জন্য দাওয়াত প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে অথবা যুদ্ধ বিগ্রহের চরম পর্যায়ে যেসব প্রচেষ্টা কাজ করা হয়, তা সবই জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর আওতাভুক্ত। ফতোয়া অনুযায়ী নিম্নরূপ কর্মসূচী গস্খহণ করা হয়েছে :

             দ্বীন ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্য সভা, সেমিনার, মাহফিল, মেলা, ক্যাম্পিং, রোড শো, ডায়ালগ, পোস্টারিং, মাইকিং, অডিও, ভিডিও, অ্যাপস, সাহিত্য, সাময়িকি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইফটিঊব, টুইটার লাইফ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা।

             উলামা সমাবেশ, টকশো, মতবিনিময় সভা করা।

             কুরআন শিক্ষার জন্য নুরানী মক্তব পরিচালনা, কুরআনের শিক্ষা প্রচারের জন্য হেরার নুর, শান্তির বারতা সাপ্তাহিক মাসিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করা।

             ইসলামী সংস্কৃতির জন্য নুরের পাঠশালা নুর মহল পরিচালনা করা।

দাওয়াহ কার্যক্রম, জিহাদফি সাবিলিল্লাহি সহ চাহিদার আলোকে আমেলীন (যাকাত অফিসার)—দেও প্রস্তাবনা, শরীয়াহ বিশেজ্ঞ কমিটি বোর্ড অব ডাইরেক্টরসএর অনুমোদন সাপেক্ষে আল্লাহর šÍÍষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গস্খহণ করা।

০৮. মুসাফির প্রকল্প

মুসাফির তার নিজের গৃহে ধনী হলেও সফরের মধ্যে সে যদি সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে তাহলে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যাবে। এখানে কোন কোন ফকীহ শর্ত আরোপ করেছেন, অসৎকাজ করা যার সফরের উদ্দেশ্য নয় কেবল মাত্র সেই ব্যক্তিই আয়াতের প্রেক্ষিতে সাহায্য লাভের অধিকারী হবে। কিন্তু কুরআন হাদীসের কোথাও ধরনের কোন শর্ত নেই। অন্যদিকে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা থেকে আমরা জানতে পারি, যে ব্যক্তি অভাবী সাহায্য লাভের মুখাপেক্ষী তাকে সাহায্য করার ব্যাপারে তার পাপাচার বাধা হয়ে দাঁড়ানো উচিত নয় বরং প্রকৃতপক্ষে গোনাহগার অসৎ চরিত্রের লোকদেরকে বিপদে সাহায্য করলে এবং ভাল উন্নত ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের চরিত্র সংশোধন করার প্রচেষ্টা চালালে তা তাদের চরিত্র সংশোধনের সবচেয়ে বড় উপায় হতে পারে।

             মুসাফিরদের চাহিদার আলোকে সহায়তা প্রদান, অতিথিশালা স্থাপন পরিচালনা করা।